আর-সালান
রোজ কলেজে যাই আসি। নিউ আলিপুরের মোড়ে বিরাট বড় দোকান রোজই ডাকে। যাওয়ার পথে সকাল নটার সময় নিঃঝুম। আসার সময় বিকেল পাঁচটায় জাফরানে জমজমাট। খুশবুখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বার্মা। একেবারে রাস্তার উপরেই সুদৃশ্য কাঁচের রান্নাঘর। শিক কাবাব বলছে – শিকেয় তোল যত দ্বিধা দ্বন্দ্ব। তন্দুরী বলছে তন্দুরস্ত হতে গেলে চাখতেই হবে আমার অমোঘ আস্বাদ। হঠাৎ ঘামে ভেজা বাসের সিটে বসে নাকে বসন্তবায়ের মত বিরিয়ানির সুবাস এলে চরিত্র চলকে ওঠে, ইড়া পিঙ্গলায় টান পড়ে, হরমোনেরা হাহাকার করে ওঠে। মনে হয় ব্রহ্ম মিথ্যা মাটন সত্য, কোলেস্টেরল মিথ্যা কিমাই ঈশ্বর। অন্তরের আহ্বান আসে – আর কতকাল have not দের মত সকাল বিকেল ভাত আর ঢ্যাঁড়সসেদ্ধ গিলবি! এই ট্রাইগ্লিসারাইডের মহাসাগরে একবার প্রাণ ভরে অবগাহন করে নে। চার দিনকি চাঁদনী ইয়ে জওয়ানি ফ্যান্টাসি। এরপরে ডাক্তারে বলে দেবে বুড়ো আঙ্গুল ছাড়া সব খাওয়া বারণ। রোদ থাকতে থাকতে খড় শুকিয়ে নে ।
ভয় পাই। কবি কলকন্ঠে গেয়ে উঠেছেন খেতে পারি কিন্তু কেন খাব। তাই রোজই প্রেয়সীদের ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দিই। আমি কিনা কমরেডের নাতি, সাচ্চা সোশালিস্ট, সর্বহারার সরবিট্রেট – সেই আমি কি আর-সালানে বিরিয়ানি খাওয়ার মত ব্যুঁর্জোয়াপনা করতে পারি। হে ভারত ভুলিও না মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী তোমার রক্ত, তোমার ভাই। কেউ যদি বেশি খাও খাওয়ার হিসেব নাও কেননা অনেক লোক ভাল করে খায়না। অতএব মন চলো নিজ নিকেতনে। দীর্ঘশ্বাসের মালা গেঁথে (ভাঁশাটা কেমন দিলাম বাব্বা) রোজই অন্তরে অতৃপ্তি নিয়ে সিক্তস্বপনে দেখি আরসালানের অনির্ব্বচনীয় আরাকান-চিকেন। সেই নার্সারি থেকে শুরু।
প্রেম নেই। অবাক জলপান সেরে যখন নিউ আলিপুরের ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীরা চোস্ত ইঞ্জিরি বলতে বলতে আরসালানের গোপন জঠরান্ত্র থেকে ছটকাতে ছটকাতে বেরিয়ে আসে, তখন জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে। নিশীথনন্দিনীরা শিকার শুঁকছে, ফুটপাথের যীশু চটের বস্তায় ঘুমিয়ে গেছে। তন্দুরের কয়লা নিবু নিবু। আরসালানের এখন অন্য রূপ। সাদা মার্বেলের উপর পথচারীর মুগুর ছাপ কাদার ছোপ সাফ করছে একমাত্র জাগ্রত কর্মচারী। একে একে নিবিছে দেউটি।
রাত ঘমিয়ে পড়ে ওই। আবার দিনের আলোয় মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা। সারাদিনের অকাজ শেষে বাসের সিটে আবার আরসালান। একবার উঁকি দিয়ে দেখব নাকি, বিধির বাঁধন কাটব আমি কি এমনই শক্তিমান? সাধু সাবধান, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। আমি দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণির রক্তে লাল। আমি শুনেছি মৃতবৎসা ছাগের কান্না। দূর! কাকে ভোলাচ্ছি? খাব খাব করছে আমার পাগলা মন, যুক্তি চাইলে চার্বাক থেকে নিৎশে অব্দি সব শুনিয়ে দেব। থাক পড়ে আমার মিডল ক্লাস বাসের সিট, আজ বিকেলে আমি একদিনের হারুন অল রশিদ দোপেঁয়াজি। চল ছন্নো।
দোকানের দুই ভাগ – আউটডোর আর ইনডোর। আউটডোরে রোলের কাউন্টার, সেখানে খদ্দেরের নাম ‘দাদা’। বাহুডোরে বেঁধে ইনডোরে গেলেই দাদা হয়ে যান ‘স্যর’। ইনডোরের মধ্যে আবার ওয়ার্ড এবং ওটি দুই ভাগ। যেখানে ছজনের চেয়ার টেবিলে আন্ডা বাচ্চা নিয়ে দম্পতিরা মোচ্ছব করেন সেটা ওয়ার্ড। আর ক্লোজড ডোরে ডাবল সীটার হল ওটি। লক্ষ্যনীয় যে আমার মত একলা লক্ষ্মণের জন্য এক চেয়ারের ব্যবস্থা নেই। মিনিমাম চারজনের টেবিলে বসে আমার একাকীত্বকেই প্রবলভাবে বিজ্ঞাপিত করতে হবে। তা হোক। তন্দুরী হাতে আবার একাকিত্ব! স্বর্গে লোকে একা হয়, নরকে আবার একা কি?
ঠান্ডা ঘর, মৃদু মোজ়ার্ট (বা ওরকমই কেউ একজন), টুংটাং গ্লাসের আওয়াজ, কলকল জল ভরার শব্দ। বেয়াড়ার স্মিতবদান্যতা। আমার সামনের টেবিলে একজন শালপ্রাংশু ব্যূঢ়োরস্ক মহাবাহু অমিতোদর মাড়োয়াড়ি বসে দুহাতে মুরগি চিবোচ্চে। ঝালের চোটে হাঁসফাঁস করছে আর খালি কাগজের ন্যাপকিনে নাক মুছছে, তারপর আবার আর এক কামড়। গালদুটো টকটকে লাল, ঝাল লেগে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, তবু ওই মুরগি ওকে ছাড়বেনা। আন্তপ্রজাতি সংগ্রাম। এপাশে আবার এক মুশকো মহিলা চিকেন চাপের ঝোল ঢেলে বিরিয়ানিতে চটকে মাখছেন। বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে। অতএব বিরিয়ানির দলা জলে ভিজিয়ে ঝাল কমিয়ে গেলার ব্যবস্থা। গ্লোবালাইজেশন। এরপর হয়তো পাশে হাতপাখা নিয়ে বসবেন। ছেলে চিবালো হাড় জুড়ালো মুরগি গেল পেটে। চারিদিকে কেমন ইনসুলিন ইনসুলিন পরিবেশ, চোঁয়া ঢেকুর, কড়কড় হাড় চিবোনোর আওয়াজ, পেপসিন ট্রিপসিনের পোয়াবারো। যত অন্তঃক্ষরা বহিঃক্ষরা গ্রন্থি আছে সব একসাথে কাজে নেমেছে। বড় ধুম লেগেছে হৃদিকমলে। একে বলে fed state।
কি খাব, কি খাব? এবার কালী তোমায় খাব ! নিয়ে আয় দেখি মেনুকার্ড, আজ যদি দ্বিতীয় ইন্দ্রের মত দধীচিরূপ পাঁঠার অস্থিতে বজ্র না বানিয়েছি তবে আমিও প্রলেতারিয়েত নই। কোরমা কালিয়া পোলাও জলদি লাও জলদি লাও। আরেব্বাস, ‘চিকেন মনসুখানি’ আবার কি জিনিস? ক্যান্টার কেস করে দিয়েছ বস। সুখে দুঃখে উত্থানে পতনে হে মুগ্ধ জননী, রেঁধেছ চিকেন শুধু, নহে মনসুখানি। আজ তবে ঝোলে জিভে পরিচয়টা হয়েই যাক। যদি চলেবল হয় তবে পরের সপ্তাহে এগজ্যামিনারকে খাওয়াতে কাজে লাগবে। হুহঁ বাবা, এম ডি পরীক্ষা বলে কথা। পড়বে পিজি বাঁশ দেবনা তাই কখনো হয়? উচিতমতো মাল পেটে পড়লে ডিগ্রি দেওয়ার কথা ভাবব, তারপর ফার্মাকোলজিটাই ... যাকগে।
এল ওই পূর্ণশশী আমার মনরাহু পানে ধেয়ে। একি, তোমায় কেন লাগছে এত চেনা? পাড়ার পিকনিকে সিদ্ধ মাংসে আলুর দমের ঝোল ঢেলে যে ঘন্ট পাকানো হয়, তার উর্দূ নাম বুঝি মনসুখানি? হবেও বা। আমি মুখ্যুসুখ্যু বাঙ্গালি, রেস্তোরায় শিঙ্গিমাছের ঝোল খেলেই খুশি, যদি তার নাম হয় শিকঞ্জি শিঙ্গালালা বা ওরকম কিছু একটা। অতএব দধীচির বদলে দধিকর্মা, বিরিয়ানির বদলে বিড়িই সই। নিত্যকর্ম পদ্ধতির মত ব্যাজার মুখে বিষয়কর্মে (অর্থাৎ গলাধঃকরণে) মন দিই। ক্ষুন্নিবৃত্তি করে ক্ষুণ্ণমনে খানিকক্ষণ হাড়ের সাথে খুঁনসুটি করি (যদিও মন চাইছে খুনখারাপি করতেই)। বেয়াড়াগুলো আড়চোখে হাসছে, এমনকি আরসালানের আরশোলাটা পর্যন্ত শুঁড় নাড়িয়ে বলছে, ওরে বোকা, কবি বলেছেন - এসেছিস মুরগি খেতে নয় মুরগি হিসেবে (বোধহয় একটু শব্দবিপর্যয় হয়ে গেল)।
নামিল আঘাত। এইমাত্র! আর কিছু নয়? কেটে গেল ভয়। এবার কি হবে? আমার দুনিয়ায় যে ভয় পাবার, বিস্ময় জাগার, রেগে ওঠার, কেঁদে ভাসানোর, চেটে সাফ করার মত আর কিছুই রইলনা। এক ছিল আরসালান, সেও গেল পেটে। তবে? বাসনার বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ডাকলাম, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষ খেয়ায়, ওরে আয়!